Translate

Thursday 1 February 2024

শনিবারের চিঠি ভাণ্ডার

শনিবারের চিঠি ভাণ্ডার


"পুন্তো পারো জিন্তো হারো

মিস্তা নারো বিস্তাসাৎ

লেঙ্গু প্রোষ জিয়ং ট্রোষ

দিঙ্গা ভোস মিস্তা বাং!

তোক্কাতারো তোক্কাতারো তোক্কাতারো তি।"


এই ছন্দবদ্ধ লেখটি অর্থহীন নয়, এটি পাঠ এত সুখকর ও আনন্দময় যে, গতকাল আমি যেই মুহূর্তে লেখাটি উদ্ধার করলাম  আশ্চর্য শিহরণ হল।

এটি অতীত রাশিয়ার একটি পুরোনো উপভাষা" কামস্কাট"

আশ্চর্য এই ভাষার মাধুর্য্য! এই ভাষার ছাঁদ এমনই যে সাধারণ কথার উপর কথা বলেই অপূর্ব শ্রুতি সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়।

তার থেকেও বড়ো কথা কামাস্কাটীয়রা আশ্চর্য এক ইন্দ্রিয়াতীত জগতের কাব্য ভাবনার মধ্যেই বোধহয় বাস করেন।

এমনই এক সাধারণ কামস্কাট দশ বছরের বালিকা আয়নার সামনে চুল বাঁধতে বসে এই ছন্দময় ভাবনার জন্ম দিয়েছে।


উপরের কবিতাটি আসলে এই বালিকার ভাবনা, যার প্রকৃত অর্থ—

" যে নাগিণী সম্প্রদায় কোন অজানিত বিবর হইতে বাহির হইয়া আমার মাথায় বাসা বাঁধিয়াছে, হে আমার কবরী, তুমি তাহাদিগকে বন্ধন করিতেছ, তুমি কম নও। আমি বারবার তোমার জয় ঘোষণা করিতেছি।"


অসাধারণ এক ভাবনা!

আধুনিক কামস্কাটকীয় ছন্দের সঙ্গে রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার বেশ মিল পাওয়া যায়। শনিবারের চিঠিতে তার প্রয়োগ সজনীকান্তের লেখায় বারবার উঠে আসে, যদিও প্রকৃত কামস্কাটের গভীর ভাবনার বদলে, সজনীকান্ত ব্যঙ্গ শব্দ প্রয়োগ করে ব্যাঙ্গাত্মক ভাবের জন্ম দেন।


এই ছন্দের শ্রষ্ঠা ছিলেন কবি মিলাং।

তবে আধুনিক কবিতায় ওরল্যাংহো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যদিও তাঁর সমস্ত সৃষ্টি একসময় নষ্ট করে দেওয়া হয়, কিন্তু কিছু কবিতা ও কাব্যার সামান্য অংশ পরে খুঁজে পাওয়া যায়। ব্লাডিভোস্ট, কামস্কাটদের যুদ্ধে পরাজিত করার পর এই কবির সব সৃষ্টি ধ্বংস করে দেয়।

বি. দ্র:  সেসময় দুইজন বাঙালি কবি সেখানে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তাঁদের নামের উপাধি দিয়ে একটি ক্লাব স্থাপিত হয় সেখানে—"রায়-সরকার" (বিনয় কুমার রায় ও দিলীপ কুমার সরকার) 


Wednesday 18 May 2022

 

গাছবাড়িটা আর কিছু এলোমেলো গল্পঃ  

গাছবাড়ির গল্প/ explore arambag gach bari

    

সন্ধে নেমেছে অনেক আগেই,তবু গ্রিল ঘেরা বারান্দায় গরম হাওয়ার চলাচল অব্যাহত। টিপটিপ করে বিন্দু বিন্দু ঘাম জন্মাচ্ছে রোমকূপের গোঁড়ায় গোঁড়ায়। জানি একটু পরেই তারা বড়ো হয়ে গড়িয়ে পড়বে। চুল গুলো মাথার উপর চুড়ো করে বাঁধতেই ঘারের কাছটা ঠান্ডা অনুভব হল। ছেলের স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটি চলছে।সারাদিন বাড়িতেই কেটে যাচ্ছে নানা ব্যস্ততায়। অন্ধকারে বারান্দায় বসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশ দেখছি। যখন ভীষণ গরম লাগে,আমি কল্পনায় বরফ দেখার চেষ্টা করি। পছন্দের মতো একটা বরফের দেশ খুঁজে নিই,আর চোখ বন্ধ করে সেই জায়গায় পৌঁছে যাই। অচেনা জায়গা হলে ছবিতে দেখা সুন্দর জায়গাগুলোকে সেই জায়গার গায়ে বসিয়ে নিই। অবশ্য এমন কল্পনা যাপন আমার অবসরের একমাত্র বিনোদন। আকাশ দেখতে দেখতেই দেখলাম, বর্ধমান থেকে সাড়ে সাতটার ট্রেনটা ধীর গতিতে প্ল্যাটফর্ম ছুঁতে ছুঁতে থেমে গেল। একঝাঁক কোলাহল ধেয়ে এল মুহূর্তের মধ্যে। খানিক হুড়োহুড়ি ওঠা-নামার মাঝখানেই গঁ-অ-অ করে আওয়াজ করে ট্রেন চলমান হল। আমার কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটল।

এ ট্রেনেই সে অফিস থেকে ফেরে। জুন মাসের চার-পাঁচ তারিখ চলছে। অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই সে বলল, ‘ গাছবাড়ি যাবে?’

--গাছবাড়ি? সেটা কোথায়?

--সে বলল, ‘ কাছেই পল্লিশ্রীতে,আরামবাগ’।

আমার কাছে পল্লিশ্রী মানেই গাছ। এবাড়িতে অজস্র গাছ আছে, যা আরামবাগ পল্লিশ্রী থেকে আনা। ঐ নার্সারিতেই নাকি গাছবাড়ি আছে।

সেবার যখন বেতলা জঙ্গলে গিয়েছিলাম, গাছবাড়িতে থাকার খুব ইচ্ছা ছিল। বুকিং করেও ক্যান্সেল করি। ঠিক থাকার উপযুক্ত ছিল না সেটা। গাছবাড়ির কথায় মনটা নেচে উঠল, কিন্তু গরমের কথা মনে হতেই ডিহাইড্রেশনের রোগীর মতো ঝিমিয়ে পড়লাম। এমন উত্তপ্ত দিনে লোকে দার্জিলিং, ডুয়ার্স যায়,গরমে গরম জায়গায় ঘুরতে যাওয়া একপ্রকার পাগলামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু মাঝে মাঝে নিয়ম ভাঙার একটা আলাদাই আনন্দ আছে। দু-দিন আগেই খবরে বলছিল, নিয়ম মেনে ৮ই জুন বর্ষা ঢুকছে বঙ্গে। হিসেব মিললে,সোনায় সোহাগা হতে পারে। গাছবাড়িতে বসে,গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রিমঝিম বৃষ্টিরও দেখা মিলতে পারে।

গাছবাড়ির এক স্টাফের সাথে আমাদের পূর্বপরিচয় ছিল,বুকিং করতে গিয়ে জানতে পারলাম, ন’তারিখ জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে ভাড়ায় বিশেষ ছাড় চলছে। মধ্যবিত্তের পকেট চিরকালই এই বিশেষ ছাড় শব্দটি শোনার অপেক্ষায় থাকে,আর সেটা শুনতে পেলে একঝলক চওড়া হাসি ঝলকিয়ে ওঠে।

ন’তারিখ সকাল,চেনা শহর বর্ধমান যেন একটু একটু করে পিছনে সরে যাচ্ছে,গাড়ির কাচের ভিতর থেকে এশহরকে দেখিনি কখনও,কেমন যেন অন্যরকম। আরামবাগ রোড ধরে ছুটতে ছুটতে কত কল্পনায় যেন মনের আনাচেকানাচে ঘুরপাক খাচ্ছে। দামোদরের চরে বালি আর জলের আলপনাকে এমন জায়গায় সূর্যাস্তের একটা কল্পনা এঁকে নিলাম মনে মনে। কতদিন ভেবেছি,এক বিকেলে ছুঁতে যাব দামোদরকে।কত গল্পই তো শুনেছি তার। ছোঁয়া হয়নি সে ইচ্ছে। একে একে অনেক চেনা গ্রাম পেরিয়ে চলেছি। পথের দু-ধারে চোখ রেখে দেখছি জীবন! মুটে জীবন,কেরানী জীবন, চাষী জীবন,চলমান জীবন আবার বসে থাকা আড্ডা জীবন। বড়ো ছায়া বিলোনো গাছটির নিচে,উবু হয়ে বসা গ্রাম্য বৃদ্ধ আড্ডা। দুই হাঁটুর ফাঁকে লুঙ্গি গুঁজে, রোদে পোড়া কালো কাঁধে একফালি গামছা ফেলা। কি আলোচনা চলতে পারে? জীবন,সমাজ,নাকি অভাব? Desmond Morris এর ‘Man Watching’ গ্রন্থটির থেকে জেনেছিলাম অঙ্গভঙ্গি ও অঙ্গবিন্যাস বিষয়টি,কিন্তু এই মানুষগুলির মুখভঙ্গি বড্ড বেশি নির্লিপ্ত মনে হল,একঝলক দেখার ফাঁকেই। সরল ভাবলেশহীন জীবন বড্ড বেশি কম্পাউন্ড গেসচারের অংশ যেন!

একটা গ্রামের বাইরের সীমানা দিয়ে বয়ে চলা রাস্তা ঠিক কতটা আর গল্প শোনাতে পারে গ্রামের? আমরা তো বেশিরভাগ সময়ই ঐ অঙ্গবিন্যাস আর ভঙ্গি দেখেই বাকি গল্পটা আন্দাজ করে নিই। তবে অনেক সময় জড় বস্তুও তার গেসচার দিয়ে অনেক গল্প বলে। চলতে চলতেই নজরে এল বিস্তীর্ণ ফাঁকা প্রান্তরের মাঝে একটা পরিত্যক্ত পাকা বাড়ি। বেশ সুন্দরই তো দেখতে ছিল! একটা ছোট্ট খোলা বারান্দা। যদিও রোদ খেলছে সে বারান্দায়,তবু বিবর্ণ! কংক্রিট ভেদ করে গাছ জন্মেছে। কার্নিশে জমেছে শ্যাওলা! বুনো ঘাসের স্বর্গরাজ্য। বন্ধ জানালা যেন তার অঙ্গবিন্যাস দিয়ে ভিতরের গল্পটা জানাতে চাইছে! একটা পরিপূর্ণ বাড়ি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ ইতিহাসের গল্পে।

 ভেবেছিলাম পথের ধারেই কোনও ঘুন্টি থেকে খাবার কিনে খাব, কিন্তু এপথে কেউ পসরা সাজিয়ে অপেক্ষা করে না পথিকের। খিদের সময় খাদ্য যদি,বিলাসিতার সোনার হরিণ হয়,তবে সে বড়ো যন্ত্রণার! এযন্ত্রণার অনুভব আমাদের নেই,কিন্তু জানি এই পথ চলার দু-পাশে অনেক চোখই খিদের সময় সোনার হরিণ খোঁজে! আমার গ্রামবাংলার অপরূপ রূপের মাঝে এ খিদের গান বড়ো বেদনার মতো বাজে। নিজের নামের সাথে মুশাফির লিখতে ইচ্ছা হয় খুব, কিন্তু আমি জানি,আমি মুশাফির নই। আমি এক ভ্রমণবিলাসী স্বল্প সময়ের পথিকমাত্র। সফর যতই ছোট হোক,পথচলার মাঝে দু-দন্ড থামা পথিকের ধর্ম। একটা জিরান-ঘুন্টিতে দাঁড়িয়ে উষ্ণ দুধ-চায়ে ভিজে ওঠা মাঠির ভাঁড়ের গন্ধ না নিলে, অসীম একটা শূন্যতা ভিড় করে মনে। একটু দূরেই একটা গনগনে আঁচ ওঠা উনুন। হালকা ধোঁয়ার একটা পরত উড়ছে তখনও। ঘুন্টির মালিক, উনুন আর আমদের মধ্যের সমস্ত প্রাচীর ভেদ করেছে একটি শব্দ প্রতীক্ষা। ওই উনুনের দিকে তাকিয়েই মনে হল, সে প্রতীক্ষায় আছে একটি জল ভর্তি কেটলির। ঘুন্টির মালিক খদ্দেরের আর আমরা, সেই তৃপ্তির এক চুমুকের। কখনও কখনও সময় কী ভীষণ ভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমরা সবাই একে অপরের পরিপূরক।

-গাড়ি থেকে নেমে বললাম, ‘চা হবে ভাই?’

--ছেলেটি জানতে চাইল, ‘কী চা দিদি? লাল চা, না দুধ চা?

-- আমি বললাম, দুটি লাল চা,আর দুটি দুধ চা। আমার ছানাটাও চা খেতে ওস্তাদ। দুধ চা ওর আর আমার।

হ্যান্ডেরলে কাপড়ের ব্যান্ডেজ জোড়ানো কেটলি চড়ে বসল গনগনে আগুনের মাথায়। দুধ মেশানো জলে চা-পাতা পড়তেই সতর্কবার্তা জারি করলাম, ‘ভাই, চিনি কিন্তু কম দেবেন’।

সবাই বলে, জিরান-ঘুন্টির চা নাকি একগজের হয়। মানে তিনবার ফোটানো। না না, এ চা একেবারে টাটকা। আমি চা-দোকানকে জিরান-ঘুন্টি বলি। পথিকের জিরান-ঘুন্টি।দু-দন্ড জিরানো তো যায়। আর মিনিট পঁচিশেক পথ বাকি।

পল্লিশ্রী মোড় থেকে  ডানদিকের রাস্তাটা বেঁকে গিয়েছে বাঁকুড়ার দিকে আর সামনের রাস্তাটা সোজা আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড। গাছবাড়ি আমাদের খুব কাছেই...

একটা বিরাট গেট দু-পাল্লার, ভিতরে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি গার্ড। গেটের গায়ে লেখা “আরামবাগ পল্লিশ্রী”। ড্রাইভার নামানো কাচদিয়ে মুখ বের করে বলল, ‘গাছবাড়ির বুকিং আছে’।

গেট খুলে গেল।

                                                    


একটু এগিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। দু-পাশে গাছ। মাথা তুলে দাঁড়ানো বড়ো গাছ ছাড়াও ছোটো ছোটো চারাগাছ। আর বড়ো বড়ো খাঁচার মধ্যে রঙ্গিন পাখির কিচিরমিচির। এখানেই নামতে হবে।বাকি পথ হেঁটে। কিন্তু, কোন দিকে? সামনে তো কোথাও গাছবাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। ওদিকে চারাগাছ দেখে জিভ লকলক করছে আমার। স্বাভাবিক আকারের নার্সারির তুলনায় এই নার্সারির আকার বর্ণনা করা মুশকিল। কোনদিকে যাব ভাবছি যখন,ঠিক তখনই মুশকিল আসানের মতো একটা সাইকেল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল একটি লোক। মুখজোড়া হাসি। আমাদের ব্যাগ-পত্তর সাইকেলে চাপিয়ে  আগে আগে সে চলতে লাগল,আর আমরা পিছে পিছে। একটা বিশালাকার খাটালে বৃহৎ আকারের খান আটেক গরু নিবিড় মনে খাচ্ছে। ডানপাশে গোবরের স্তুপ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে। একঝাঁক মাছি ভনভন করে ঘুরে মরছে। কখনও কারোর কানে,অথবা থ্যাবড়া মুখের উপর জেগে থাকা নাকের ছিদ্রপথে প্রবেশের অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। গরুর লেজ,চামড়ের মতো এপাশ-ওপাশ দুলছে। ভাসাভাসা নির্লিপ্ত চোখের উদাস দৃষ্টি কোনদিকে বুঝে ওঠা মুশকিল। কোনও দিনও বুঝতে পারিনি, জাবর কাটতে কাটতে গরু ঠিক কোন দিকে তাকায়,অথবা কী ভাবে? গরু দেখেই মনে এল দুধের কথা। আমাদের পথপ্রদর্শককে বললাম-

খাঁটি দুধের চা পাওয়া যাবে এখানে?

লোকটি হেসে বললে, ‘ হ্যাঁ, ম্যাডাম।চা তো পাবেনই,চাইলে দুধও খাওয়াতে পারি’।

শুনেই লোভ হল। এমনিতেই আমি দুধ-চা লোভি মানুষ। অচেনা কারোর বাড়িতে চট করে চা খেতে ভয় লাগে, কারণ চা-বিলাসি মানুষতো, একটু উনিশ-বিষ হলেই মনে হয়,চা-টাই মাটি হল। মন খারাপ হয়ে যায়।

খাটালের প্রাচীর কেটে একটা ছোট্ট সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। উপরে রাস্তা। দারকেশ্বর নদের পাড়ের বাঁধ এটা। দূরের গ্রামের সাথে মূল সড়কের সংযোগ ঘটিয়েছে একটা কালো পিচের রাস্তা। সাইকেল,মোটরসাইকেল যাওয়া-আসা করছে। পুরো প্রকৃতি জুড়ে একরাশ নিস্তব্ধতা! ঘন ঘাছের জঙ্গলের বুক চিঁড়ে এরাস্তা চলে গিয়েছে কোনখানে! সরু রাস্তা পেরিয়ে ওই বাঁধের ঢাল বেয়ে নেমে গিয়েছে সিঁড়ি।একটা তারকাঁটার গেট খুলে লোকটির পিছু পিছু ভিতরে প্রবেশ করলাম।

 ‘এ কোথায় এলাম!’

                                                          


বিস্মিত আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম। এক কোন মায়াবী আশ্রম, নাকি পবিত্র তপোবন! সুউচ্চ বৃক্ষরাজি সারি সারি মাথা তুলে আকাশমুখী। একটা ঘনছায়া ঝিরঝির করে ঝড়ে পড়ে বনময় ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রখর গ্রীষ্মের দাপটকে ম্লান করে শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়েছে যেন। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছায়া মাখতে মাখতে এগিয়ে চললাম। বড়ো বড়ো গাছের পাদদেশে দলবেঁধে দুলছে ঝোঁপ-ঝাড়। একটা ছোট্ট ঝোরার মতো নালার উপর বাহারি ছোট্ট বাঁধ পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম গাছ-বাড়ির সামনে। তারকাঁটার সীমানার গা-ঘেঁঘে পরপর চারটি তালগাছের উপর দাঁড়িয়ে আছে গাছবাড়ি। ফরাক্কায় থাকতে আমাদের সামনের কোয়ার্টারে একটা খেজুর গাছে ঝুলতে দেখতাম বাবুই পাখির বাসা। নিখুঁত বুনন। গাছবাড়ি গুলি দেখেই মনে মনে হল পাখিরবাসার মতো বাড়িগুলি যেন মানুষের বাসা। প্রতিটি বাড়ির গায়ে লাগা একটি করে আমগাছ। ডালপালা দিয়ে বাসাগুলি যেন ঘিরে রেখেছে, চাটাইয়ের দেওয়াল, কাঠের সিঁড়ি আর বাঁশের সরু বারান্দা। হাঁটলেই মচমচ শব্দ হয়। চারটি বাড়ির একটি রেস্টুরেন্ট। দুটি করে জোড়া। ভারি সুন্দর নাম বাড়িগুলির। ‘আম্রপালি’, ‘গোলাপখাস’, ‘তোতাপুরি’, আর রেস্টুরেন্টের নাম ‘ হিমসাগর’।

‘আম্রপালি’ আমাদের আগামী দু’দিনের বাসস্থান। হিমসাগর আর আম্রপালির একটি কমন কাঠের সিঁড়ি। কিছুটা উঠে ডানদিকে আম্রপালি আর বামদিকে হিমসাগর। ঠিক একই ভাবে যুক্ত পরের বাড়ি দুটির নাম “ গোলাপখাস” আর “তোতাপুরি”। সবই আমের নাম।

তখনও রেস্টুরেন্টের ভিতরটা দেখিনি, আমগাছের বনে দাঁড়িয়ে আছি। সাইকেলে যিনি লাগেজ নিয়ে এলেন, তিনি লাগেজগুলো একটা টেবিলে রেখে সামনেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ বাইরেই অপেক্ষা করতে হবে,বুঝলাম ঘর আমাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। চারিপাশের ছায়ামেদুর বনানী জুনের তীক্ষ্ণ তাপকে শুষে নেওয়ের পরও যেন তাপের হলক লাগছে। তবু মনজুড়ে প্রসন্নতা। হঠাৎ দেখি তিনটি শাঁসওয়ালা ডাব নিয়ে একটি ছেলে এগিয়ে এল। এখানে অতিথিদের এভাবেই আপ্যায়ন করা হয়। একটু দূরেই রেস্টুরেন্টের বাইরে,রান্নাঘরের ঠিক সামনেই পাতা আছে একটা কাঠের টেবিল। চারটে চেয়ার গোল গোল কাঠ জোড়াদিয়ে তৈরি। বন্য আভিজাত্য রয়েছে একটা। ফুট কয়েকদূরে তারের বেড়া, ওপারে দারোকার ক্ষীণ স্রোত!

 আমরা আম্রপালির অন্দরে ঢুকে চমকে গেলাম। সব সুযোগসুবিধা যুক্ত সুসজ্জিত রুম। কাচের ঘেরা জানালার ওপাশে দেখতে পেলাম সবুজ গাছের ডাল জানালা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে। জানালা খুলে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে সে সবুজ। পাতার ফাঁকে চোখ আটকাল খুব কাছ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণকায় দারকেশ্বর নদ। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে জল প্রায় নেই। বুকে জমে আছে ময়লা! স্নান সেরে বাইরে এসে বসলাম ঐ উন্মুক্ত কাঠের চেয়ারে। একরাশ প্রশান্তি মন জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। এমন নির্জনতায় গা-ভাসাব বলেই তো এই গরমেও ছুটে আসা। সামনেই রান্নাঘর। একটা টেবিল ঘিরে দু-তিনজন স্টাফ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এক’টা প্রায় বেজে গিয়েছে,পেটে ছুঁচোর ডন চলছে। খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করতেই স্টাফেদের একজনের মুখটা ছোট্ট হয়ে গেল। বলল—

ম্যাডাম, আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।

বললাম, এখনও খাবার হয়নি?

লোকটি কাচুমাচু মুখে জানাল, হয়েছে তবে, রেস্টুরেন্টে যাঁরা খাচ্ছেন,তাঁরা অন্য কোনো গেস্টকে ঐ মুহুর্তে সেখানে না পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

মানে! এটা আবার কেমন আচরণ! রেস্টুরেন্টে একটা বিশাল বড় টেবিলে ছ-সাত জন খেতে বসতে পারে। একটাই টেবিল,তবে বাকি অংশে যে কেউ বসতে পারে। কীভাবে একটা পরিবার সেই কমন স্পেসকে পার্শোনাল করতে পারে! বিস্মিত হলাম, কিন্তু রাগ দেখালাম না। কারণ, এখানে যাঁরা কাজ করেন কেউ প্রফেশনাল নয়। সবাই গ্রামের মানুষ। তাঁদের সাহস কোথায় শহুরে বাবুদের প্রশ্ন করার বা আদেশ অমান্য করার। আমাদের সহযোগিতায় যেন লোকটি বড়ো করে শ্বাস নিল। বলল—

মালিককে বলা হয়েছে,এই সমস্যার কথা। আপনারা সত্যিই ভালোমানুষ!

 ভালো মানুষ কিনা জানি না, তবে মানুষর অসহায়তা বোঝা মানুষেরই ধর্ম। কিছুক্ষণ পর সেই পরিবারের দুই মহিলা সদস্য ও এক পুরুষ সদস্য গটমট করে নেমে এল কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। বাইরে বসার ইচ্ছায় আমরা যেখানে বসে আছি সেই দিকে একবার তাকিয়ে দেখেও নিল। ভাবলাম হয়তো এবার আঙুল নেড়ে বলবে –‘এই ওঠ ,ওখানে আমরা বসব’। না  আমাদের বলার সাহস বোধহয় জোটাতে পারেনি, তবে স্টাফেদের একটি ছেলেকে আঙুল নেড়ে তুই সম্বোধনে কাছে ডেকে কিছু একটা বলল। হায়রে...বাবুয়ানি! মনে মনে একরাশ করুণা ছুঁড়ে দিলাম ঐ পরিবারকে। রবিরার দুপুরের পর পুরো ফাঁকা জায়গাটা। পুরোটা জুড়েই যেন আমাদের রাজত্ব। একটি স্টাফ ফুচুদা বললেন, ‘স্যার, আর কোনো অসুবিধা হবে না। যা খাবেন শুধু আগে থেকে বলে দেবেন,না হলে জোগাড় করা মুশকিল। বললাম, শাঁস আছে এমন ডাব আর পাওয়া যাবে?

উঁনি জানালেন আনিয়ে রাখবেন। সন্ধের স্ন্যাক্স আর রাতের মেনুও দুপুরেই জেনে নিলেন। বেলার দিকে গরমের তীব্রতা উপেক্ষা করা দায়। এসিরুমে সারাটা দুপুর কাটিয়ে ঠিক বিকালে নেমে এলাম নীচে খোলা লনে। পায়ের নীচে ঘাসহীন মাটি। মাথার উপর গাছের ছায়া। সামনেই অবারিত উন্মুক্ত প্রকৃতি। সন্ধে হওয়ার আগেই ছোটু বলে ছেলেটি নার্সারি দেখে আসার কথা বলতেই পা বাড়ালাম ঐ দিকে। নার্সারির মালিকের অদ্ভুত সখ। অসংখ্য পাখির খাঁচা। ম্যাকাউ থেকে অনেক অজানা রঙিন পাখির প্রতিটি খাঁচা দেখার জন্য আলাদা লোক আছে। আমরা যেতেই একটা বিশেষ জীবাণুনাশক ওষুধ স্প্রে করে আমাদের খাঁচার ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হল। এমন অভিজ্ঞতা নতুন আর বড় অদ্ভুত। হাতে পাখির খাবার নিতেই একসাথে অনেক পাখি এসে বসল হাতের উপর। হাত থেকে খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল দানা। এক অদ্ভুত অনুভূতি!



ধীরে ধীরে সন্ধে নেমে এল। ফিরে এলাম আগের জায়গায়। অদ্ভুত মায়াময় লাগছে জায়গাটাকে। রান্নাঘরের সামনে একটা ছোট্ট আলোয় চারিদিকে এক আলো-আঁধারি খেলায় গা-ভাসিয়ে এক অনন্ত শূন্যের দিকে অলস ভাবে চেয়ে থাকা আর একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া সময়কে উপভোগ করার যে একান্ত অনুভূতি,তা বোধহয় শব্দে সঠিক প্রকাশ সম্ভব নয়! ঝিঝিঁর ডাকে নিস্তব্ধতার অস্তিত্ব প্রমাণ করছে প্রকৃতি। ঘরোয়া পকোড়ার সাথে,খাঁটি দুধের ঘন চা বিলাসিতার গায়ে যেন নক্সা চাদর! পরের দিনের জন্য তিন গ্লাস খাঁটি দুধ অর্ডার দিয়ে রাখলাম। রাধুনি প্রফেশনাল নন,কিন্তু অসাধারণ তাঁর হাতের রান্না! সম্পূর্ণ বাড়ির পরিবেশ যেন। টুকরো টুকরো হাসি ঠাট্টা, দোলনায় বসে গান শোনা, যেন ব্যস্ত জীবনের মাঝে স্বপ্নের বাস্তবতা। উপরের দিকে মুখ তুলে চাইতেই দেখলাম, ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি আলো জ্বলিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। জোনাকির আলো আসলে সঙ্গীকে সঙ্গমে আকৃষ্ট করার জন্য। একটা ছোট্ট পতঙ্গের জীবনচক্র প্রকৃতির শোভা হতে পারে,তা জোনাকিকে এমন উন্মুক্ত ভাবে জ্বলতে না দেখলে কল্পনা করা সম্ভব নয়।

রেস্টুরেন্টটি কিন্তু ভীষণ সুন্দর! আর রোমান্টিক। ভিতরের মৃদু আলোয় মায়াবী মুহূর্তরা ভিড় করে,আর কাচের দেওয়ালের ওপারে আধজাগা সভ্যতার টিমটিম করা আলো এক অন্য জগতের অনুভূতি জাগায়। পরেরদিন এই গ্রাম্য মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ছোট্ট করে আনন্দে মাতলাম! জীবনের সাথে একটা নতুন বসন্ত জুড়ে যাওয়ার আনন্দ উদ্‌যাপন। জীবনকে এভাবেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা। এখানে জীবন আর প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক যেন। দু’হাতে তোলো আর মেখে নাও। চাওয়া আর না-পাওয়ার অতলে হারাতে হারাতে দুটি দিনের জীবনকে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ আরোও দ্বিগুণ হল, যখন জানলাম আমাদের মতো ঘুরতে আসা অসংখ্য মানুষের বিলাস যাপনের টাকায় পরিচালিত হয় একটি অনাথ আশ্রম “ উত্তরায়ণ”।

হ্যাঁ, এটা একদম একশ শতাংশ সত্যি। এই তিনটি গাছবাড়ির ভাড়া, অতিথিদের খাওয়া থেকে যে উপার্জন হয়,সেই টাকায় একটি অনাথ আশ্রমের অসংখ্য বাচ্চার প্রতিপালন হয়। আঁকা হয় স্বপ্ন সেই অনাথ শিশুদের চোখে।

দোলনায় দুলতে দুলতে পার করতে ইচ্ছা করে রাত, অথাবা শতাব্দীর পর শতাব্দী। কালের নিয়মে ভোর আসে। শুরু হয় ব্যস্ততা রোজকার জীবনে ফেরার। লাগেজ গুছিয়ে নীচে নামি। বিদায় বলতে ভালো লাগে না। বেরোনোর আগে বললাম, ‘আবার আসব’ যদিও জানি কিছু পথ থাকে,যে পথে ফেরা হয় না আর, অথবা ফিরতে নেই, শুধু রেখে যেতে হয় পদচিহ্ন। গাড়ি আবার ছুটতে থাকে শহরের ব্যস্ততায়।

যোগাযোগঃ Aambagan, (pallisree, arambag)

Contact no: 9230085084

 

Saturday 5 March 2022

How to make Sahi Garam Masala at home

 ঘরে তৈরি শাহি গরম মশলা

কেনা গরম মশলা রান্নায় ব্যবহার করলে অনেক সময় খাওয়ার পর বুক জ্বালা করে। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য বাড়িতে তৈরি গরম মশলা ব্যবহার করুন রান্নায়। কীভাবে করবেন, নীচে পদ্ধতি বর্ণনা করা হল

 

উপকরণ: ১০০ গ্রা. মশলার অনুপাত

                ৩৫ gm. জিরা

                 ১০ gm. বড়ো এলাচ

                  ১০ gm. ছোটো এলাচ

                   ১০ gm কাবাবচিনি

                   ১০ gm. শুকনো আদা

                   ১০  gm. লঙ পিপার

                    ১টি জায়ফল 

                    ১টি জয়ত্রী

প্রণালী: খাওয়াতে হালকা গরম করে মিক্সিতে গুঁড়ো করে নিতে হবে

এরপর একটা এয়ার টাইট কন্টেনারে সংরক্ষণ করে রেখে দিতে হবে।

এই গরম মশলা বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করার সম্পূর্ণ উপযোগী। ও স্বাস্থ্য সম্মত। 

Thursday 3 March 2022

Simple Guidance For You In Ranchi


 ভ্রমণ ডায়েরির পাতা

রাঁচি

Simple Guidanc For You In Ranchi: 

শেষ পর্ব

সকাল থেকেই মনটা বিষাদগ্রস্ত,যেন শরীর জুড়ে ক্লান্তি। আসলে ক্লান্তি তখনই মানুষকে বেশি চেপে ধরে যখন মনও ক্লান্ত হয়। বুঝতে পারছিলাম,এক্লান্তি যতটা না শরীরে, তার থেকে অনেক বেশি মনে। রাত ন’টায় ফেরার ট্রেন! আবার ফিরে যাওয়া ব্যস্ততা আর অবসাদের ভিড়ে। রাঁচির বিশুদ্ধ প্রকৃতি যেন বেঁধে ফেলেছে মনকে। সারাদিন ঘুরব বাকি জায়গা গুলোতে। সকাল ন’টা বাজতেই প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে পড়লাম। অটোর ড্রাইভারদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আজ কাঁহা জায়েঙ্গে হামলোগ?’

বললেন, ‘ ভগবান বিরসা বায়োলজিক্যাল পার্ক’।

রাঁচি শহর থেকে কুড়ি মিনিটের রাস্তা। সকাল থেকেই মেঘলা ছিল আকাশ। পার্কের সামনে পৌঁছাতেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। এই পার্ক সম্পর্কে কিছু বলার আগে একটাই কথা বলব, যদি কেউ রাঁচি আসেন, তবে অবশ্যই এই পার্কটিকে না দেখে যাবেন না। এতে কি আছে আমি লিখে বোঝাতে পারব না, কারণ প্রকৃতিকে লিখে বোঝানো যায় না। শুধু অনুভব করতে হয় মনে মনে। গভীর অরণ্যের মাঝে প্রাণবন্ত বন্যপ্রাণীর দল। খাঁচার ঘেরাটোপের বাইরে খালিচোখে বাঘ দেখতে হলে এখানে অবশ্যই যেতে হবে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সাদা হরিণের দল লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। চিতল হরিণ,কৃষ্ণসায়রের কাজল কালো চোখের দিকে একবার তাকালে আর কোনো দিন মুছে ফেলা যাবে না মনথেকে। ভল্লুক,হাতি,নীলগাই,বনবিড়াল...না, লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে যাব আমি। কোথা থেকে যেন বয়ে গেল তিন ঘন্টা। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে ফিরে চললাম রাঁচি শহরের দিকে। সোজা রাঁচির রকগার্ডেন। পাথরেও যে প্রাণের স্পন্দন জাগে, এখানে এসে প্রথম অনুভব হল। অপূর্ব এই জায়গা! থরে থরে সাজানো পাথরের খাঁজে খাঁজে সবুজ গাছপালা মুকুটের মতো সেজে রয়েছে। উপর থেকে চোখে পড়ল বিস্তৃত স্থির জলরাশি। কাঁখে ড্যাম। ফুরফুরে হাওয়ায় মন বারবার উদাস হতে চায়। কিছুটা সময় নীরবে বয়ে যায়। রকগার্ডেন থেকে সোজা ‘নক্ষত্র গার্ডেনে’ রাঁচির গোলাপ বাগান। অজস্র গোলাপ! সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভার দা আগেই বলেছিলেন, এখানে পাহাড়ি মন্দির বলে একটা বিখ্যাত মন্দির আছে। সন্ধের একটু আগেই সেখানে পৌঁছালাম। অনেক সিঁড়ি,প্রায় ২০০ তো হবেই। ক্লান্ত শরীরে শেষ প্রান্তে পৌঁছাতেই জুড়িয়ে গেল মন। কি শান্ত! চূড়ায় একটা ছোট্ট মন্দিরে রয়েছে একটা শিবলিঙ্গ। ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়ে নেমে এলাম নীচে। অনতিদূরেই রয়েছে জগন্নাথ মন্দির। সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা এই রাঁচি শহরে। কেমন যেন এক আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠেছে ঐ অটোচালকের সঙ্গে। মাত্র তো তিনদিন! আসলে মনের বন্ধন যদি খাঁটি হয়,তা তিন মিনিটেই গড়ে তোলা যায়। হোটেলে ফিরলাম তখন সাড়ে ছ’টা বাজে। ট্রেন ধরার আগে সবসময় একটা অস্থিরতা কাজ করে। আসার সময়ও ছিল এমন অস্থিরতা, কিন্তু তারমধ্যে একটা আনন্দ মিশে ছিল। আর ফেরার মুহূর্তে মিশে আছে বিষাদ। ঠিক আটটায় অটোয় চেপে বসলাম। আধঘন্টা সময় লাগবে স্টেশন পৌঁছাতে। চলতে চলতে একটা দোকানের সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল অটোটা। ড্রাইভারদা দোকান থেকে একটা বড় ক্যাডবেরী কিনে ধরিয়ে দিলেন আমার ছেলের হাতে। অজান্তেই চোখের কোণটা যেন ভিজে এল। এভাবেই গড়ে ওঠে বন্ধন। মনুষ্যত্বের বন্ধন,যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ব্যাগ গুলো প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে যেতে যেতে ঘুরে তাকালেন একবার। হাসি বিনিময়ের শেষে অজান্তেই হাত নেড়ে বিদায় জানালাম একে অপরকে।

সমাপ্ত।

বিশেষ তথ্যঃ হাওড়া থেকে আমরা রাঁচি গিয়েছিলাম হাতিয়া এক্সপ্রেসে। এটা বেশ সুবিধাজনক, কারণ ভোরবেলায় রাঁচি পৌঁছায়।

আমাদের ভ্রমণ ছিল [ নেতারহাট ২দিন যেদিন পৌঁছালাম আর পরের দিন >>> ওখান থেকে ভাড়ার জিপে বেতলা। পথে লোধ জলপ্রপাত কে দেখে নেওয়া >>> বেতলার নির্জনতায় ২দিন অর্থাৎ জার্নির দিন ও পরের পুরোদিন>>> ওখান থেকে রাঁচি পৌঁছালাম ঠিক সন্ধের মুখে। ৩দিন রাঁচিতে। দুটি পুরোদিন ও একটি অর্ধদিন। শেষদিন রাতের ট্রেনেই ফেরা।

ট্র্যুরটি দুটি ভাগেও আপনারা করতে পারেন।হাতে সময় কম থাকলে নেতারহাট ও বেতলা। অন্য একটি ট্যুরে রাঁচি।

নেতারহাটে কী দেখবেন ও কোথায় থাকবেন?

ম্যাগনোলিয়া সানসেট পয়েন্ট, আপার ঘাগরি, লোয়ার ঘাগরি, পায়ে হেঁটে এখানকার প্রকৃতিকে উপভোগ করা ও জনজীবন দেখা।

থাকার জায়গাঃ সরকারি নিবাস হোটেল “প্রভাত বিহার” এখান থেকেই সব থেকে ভালো সূর্যোদয় দেখা যায়। এছাড়াও কাছাকাছি ২/৩টি হোটেল আছে। বুকিং অনলাইন করা যায়।

বেতলাঃ জঙ্গল সাফারি অবশ্যই করবেন। বেশি মজা এলিফ্যান্ট সাফারিতে। ২টি হাতি আছে,প্রতিদিন দুটো সাফারি হয়,বুকিং আগেরদিন বিকালেই করে রাখতে হয়। কাছাকাছি একটি ফোর্ট আছে, ফরেস্ট থেকে হাঁটা পথে একটা মিউজিয়াম আছে।

ফরেস্টের লজ ছাড়াও রাস্তার পাশেই বেশ ভালো কয়েকটি প্রাইভেট হোটেল আছে।

রাঁচি থাকা ও দেখার জায়গাঃ রাঁচি মেইন স্টেশন রোডের উপরেই বিভিন্ন মানের ও দামের পছন্দসই হোটেল আছে।

ঘোরার জন্য এখানে অটোস্ট্যান্ড থেকে অটো বা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি পেয়ে যাবেন।

জোনহা জলপ্রপাত, হুন্ড্রু জলপ্রপাত, দশম জলপ্রপাত,সূর্যমন্দির, দেউরি মন্দির, ভগবান বিরসা বায়োলজিক্যাল পার্ক, রক গার্ডেন, নক্ষত্র গার্ডেন, পাহাড়ি মন্দির, টেগর হিল, কাঁখে ড্যাম।

এই সমস্ত জায়গাগুলি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন এই ব্লগের রাঁচি ভ্রমণের বিভিন্ন পর্বে। ব্লগের ভ্রমণ লেবেলে ক্লিক করলে সব ভ্রমণ দেখতে পারবেন।

এই পর্বেই শেষ হল রাঁচি ভ্রমণ।

Sunday 27 February 2022

Unique Bengali Fish Recipe/Ruli Batter Fry / রুলি মাছের ব্যাটার ফ্রাই

রুলি মাছের ব্যাটার ফ্রাই

আজকের যে মাছের পদটি আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি, সেটি একটি সামুদ্রিক মাছ। প্রচলিত দুটি নাম। রুলি বা আমুদি মাছ। মাছ বাঙালির প্রিয় একটি খাদ্য। কথায় বলে, মাছে-ভাতে বাঙালি। 

আসুন পদ্ধতিটি জানাই>>

উপকরণ: রুলি মাছ / একটুকরো লেবু/ লবণ/ ১ চামচ লংকা গুঁড়ো /১/২ চামচ হলুদ/১/৪ চামচ চিনি/ হাফ কাপ বেসন/ হাফকাপ চালের গুঁড়ো / ভাজার জন্য রাইস অয়েল। 


রুলি মাছের ব্যাটার ফ্রাই 

Ruli Batter Fry 

প্রণালী : 

প্রথম পর্ব : রুলি মাছ ধুয়ে মাথা বাদ দিয়ে লবণ, হলুদ আর লেবুর রস মাখিয়ে ১৫ মিনিট ম্যারিনেট করতে হবে। 

 দ্বিতীয় পর্ব : প্রস্তুত করার জন্য তেল বাদে বাকি সব উপকরণ ভালো করে মিশিয়ে জল দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। 

তৃতীয় পর্ব : এবার কড়াইতে তেল গরম করে মাছগুলি ব্যাটারে ডুবিয়ে হালকা ভেজে নিতে হবে। 

চতুর্থ পর্ব :রপর ঐ ভাজা মাছ গলোকে দ্বিতীয়বার ব্যাটারে ডুবিয়ে আবার ভেজে নিতে হবে। 

এই পর্বেই প্রস্তুত রুলি মাছের ব্যাটার ফ্রাই। 

স্ন্যাক্স বা ভাতের পাত ডাল সহযোগে এই পদটি আনন্দদায়ক। 



Monday 21 February 2022

Tomato Jhal Tok / টমেটোর ঝাল টক

টমেটোর ঝাল টক 

মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সম্পদ গুলিতে বারবার বাঙালি রান্নার কথা ঘুরে ফিরে উল্লেখিত হয়েছে। ভেতো বাঙালির শাক দিয়ে শুরু করে শুক্তো, মৎস্যপদ অতিক্রম করে অম্বলে সমাপ্তি হত। যদিও এরপরে থাকত মিষ্টান্ন, তবে তা ভাতে খাওয়ার জন্য নয়।

কাজেই সব ভালো, যার শেষ ভালো । তাই এই অম্বল পদটি অত্যন্ত গুরুত্বদিয়েই রান্না হত বাঙালির পাকশালায়।

ছোটো থেকেই একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতো টক আর চাটনির প্রভেদ কী? কারণ মা বাড়িতে টমেটোর চাটনি, মাঝে মাঝে আমড়ার চাটনি বানাতেন। মিষ্টি দিয়ে যতটা টক কাটানো যায়, ঠিক ততটা চিনি দিতেন, সাথে টক স্বাদ ও থাকত। আবার ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে, তেঁতুল দিয়ে ঐ একই রকম ভাবে যে চাটনি বানাতেন, সেটাকে বলতেন টক।

কাজেই সবটাই ছিল চাটনি আর টক। কিন্তু বিয়ের পর, এবাড়িতে যখন এলাম, দেখলাম অন্য রেসিপি, দুটোর। এখানে টক মানে চিনি বর্জিত খাট্টা তরল। যদিও আমার জন্য এক কড়াই ঝোলে ২ চামচ চিনি দেন শ্বাশুড়ি মা।

কিন্তু এখন টক ও চাটনির বেসিক সংঞ্জাটা আপনাদের জন্য দিলাম।

টক ও অম্বল:  টক শব্দটি সংস্কৃত 'তক্র' যা ঘোল নামে পরিচিত। এর থেকেই উৎপত্তি বলে ধারনা করা হয়। 

অম্বল শব্দটি সংস্কৃত>পালি>প্রাকৃতের পথ অতিক্রম করে বাংলায় অম্বল নাম নিয়েছে। এরা আসলে একই অঙ্গে দুটো নাম। অম্বল  হল, যে কোনও টক ফল, সবজি দিয়ে তৈরি চিনি বর্জিত তরল বা খাট্টা ঝোল। (বি.দ্র. এখন অনেকে ভীষণ খাট্টা ভাবটা দূর করতে ১/২ চামচ চিনি যোগ করেন)

চাটনি: টক ফল বা সবজি দিয়ে তৈরি চিনি মিশ্রিত ঘন পদ হল চাটনি। 

টকের মধ্যে অম্বল ও চাটনি দুটোই পড়ে। 


https://youtu.be/HAoUdTqgwBM

আজকের রান্না এই  টক বা অম্বল

প্রধান উপকরণ : টমেটো/ আমচুর পাউডার / লবণ/ হলুদ

আনুসাঙ্গিক : রসুন ও কারিপাতা

ফোড়ন: সরিষা, শুকনো লংকা, কাঁচা লংকা

প্রণালী :

প্রথম পর্ব : সরিষা তেলে গোটা সরিষা, লংকা, রসুন, কারিপাতা ফোড়ন দিতে হবে। 

দ্বিতীয় পর্ব : কাটা টমেটো যোগ করে ভালো করে কষাতে হবে। সেই সঙ্গে লবণ ও হলুদ যোগ করে কিছুক্ষণ নেড়ে পরিমান মতো জল যোগ করতে হবে। একবার ফুটে উঠলে, আমচুর পাউডার মিশিয়ে কিছুক্ষণ ফুটিয়ে, নামানোর আগে  আরও একবার কারিপাতা যোগকরে নামিয়ে পরিবেশন। 

শেষপাতের খাট্টা, মুখের স্বাদ কোরক খুলে যাবে। শেষ পাতের অম্বল আসলে হজমে সহায়তা করে, তাই এটি খাওয়ার শেষে খেতে হয়। 



Sunday 30 January 2022

ষোলোভূজা দেবী ও দশম প্রপাতের গল্প :Simple Guidance For You In Ranchi:

 


ভ্রমণ ডায়েরির পাতা

রাঁচি

ষোলোভূজা দেবী ও দশম প্রপাতের গল্পঃ A Simple Guidance For You In Ranchi:



Click on video button 👆

রাঁচি ভ্রমণের কিছু ছবি ভিডিও আকারে দেওয়া হল। 

:Simple Guidance For You In Ranchi: deuri temple, dasam falls


শহুরে ব্যস্ততা ও উষ্ণতা ছেড়ে আমরা ক্রমশ প্রবেশ করছি গ্রাম্য শীতলতায়। রাঁচি থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক যাওয়ার পরই একটা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের অটো।

 দাদা বললেন--

“রাঁচির বিখ্যাত ‘দেউরি মন্দির’ এটা। আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি,আপনারা গিয়ে দেখে আসুন”। 

অটোতেই জুতো খুলে শালপাতার ঠোঙায় ফুলের মালা আর প্রসাদ নিয়ে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে। লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে গেলে সারাদিন লেগে যাবে। সেদিন কোনো একটা বিশেষ তিথি ছিল। দূর দূর থেকে স্থানীয় দেহাতি মানুষের ভিড়ে ঢেকে আছে মন্দির। ভিতরের মন্দিরটি বহু প্রাচীন কালো বালিপাথরের। মন্দিরের ভাঙাচোরা ও কালো বর্ণ বুঝিয়ে দেয় এই মন্দির অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।

সত্যিই তো এই মন্দিরের একটা প্রাচীন গল্প আছে,সে গল্পে এক আদবাসী রাজাও আছেন। রাজা 'কেরা'। প্রায় ১৩০০ সাল তখন, সিংভূমের তখন মুন্ডারাজা কেরা রাজত্ব করছেন। ছামরু পান্ডা নামের এক ব্রাহ্মণ পুরোহিত বছরে দু-বার এই রাজ্য পরিদর্শনে আসতেন। সেবার রাজা কেরা এক যুদ্ধ জিতে রাজ্যে ফিরেছেন সবে। সে সময় দেখা করতে এলেন ছামরু পান্ডা। রাজা তাঁকে নিজের রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুরোধ জানালে, রাজার সম্মানার্থে ছামরু পান্ডা সেখানেই থেকে গেলেন। পুজোপাঠ ও সাধনায় অতিবাহিত করতে লাগলেন দিন। জঙ্গলের এক পরিত্যক্ত অংশে ছমরু পুরোহিত প্রতিদিন দেবতার আরাধনা করতেন। একদিন তিনি তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। এমন সময় দেবী দুর্গা তাঁকে দর্শন দিলে, সে কথা তিনি মহারাজকে জানালেন। এই ঘটনার পরেরদিন থেকেই রাজা কেরা, সেই স্থান পরিষ্কার করার কাজে লোক নিযুক্ত করলেন।সেখানে কাজ করার সময় হঠাৎ তারা আবিষ্কার করল একটি কালো পাথর। তারা ভয় পেয়ে সকলেই ফিরে গেল, কিন্তু পরেরদিন আবার কাজে এসে তারা দেখল এক আশ্চর্য দৃশ্য। সেই স্থানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে এক কালো পাথরের মন্দির। ভিতরে রয়েছেন ষোলো ভূজা দেবী।

 দেবী দুর্গার অবতার বলেই মানা হয় এই ষোলোভূজা দেবী কালিকাকে। স্থানীয় আদিবাসী মানুষরা এখানে নিত্য পুজো দেন। বাঁশের খুঁটিতে হলুদ ও লাল সুতো বেঁধে তাঁরা মানত করেন ঈশ্বরের কাছে। সপ্তাহে ৬দিন পুজো করেন আদিবাসী পুরোহিতরা ও একদিন পুজো করেন ব্রাহ্মণ পান্ডা। এইটা এই মন্দিরের পুজোর রীতি

Simple Guidance For You In Ranchi: deuri temple,dasam falls


মন্দিরের স্থাপত্যের বিশেষত্ব হল এই গঠন পদ্ধতি। কোনোরকম বালি সিমেন্ট বা সংযুক্তকারী উপাদান ছাড়াই শুধুমাত্র পাথরের সাথে পাথরের ইন্টারলক সিস্টেমের মাধমে এই মন্দিরটি গঠিত হয়েছিল পায় ৭০০ বছর আগে। অনেকে বিশ্বাস করেন, মন্দিরের আসল নির্মানকর্তা আসলে রাজা অশোক। যখন তিনি কলিঙ্গদেশে সামরিক অভিযানে যাচ্ছিলেন, তখন এই মন্দিরের নির্মাণ করেন। মন্দিরের ষোলোভূজা দেবী মুর্তিটি কালো বর্ণ ও উচ্চতেয় ৩ফুট। মন্দিরের আকৃতি ও গঠন ওড়িশার বিভিন্ন মন্দিরের আদলেই।

  মন্দিরের বাইরে তৈরি হয়েছে রঙিন আধুনিক মন্দির,যার দেওয়ালে ছাদে আঁকা রঙিন দেবদেবীর ছবি। একসময় এই প্রাচীন মন্দিরটির কথা অনেকেই জানতেন না। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের তৎকালীন ক্যাপ্টেন ধোনি ও তাঁর পরিবার প্রতিদিন আসতেন এই মন্দিরে পুজো দিতে এমনিটাই জানাগেল স্থানীয় মানুষদের মুখথেকে।

মন্দির দর্শন ছেড়ে আমরা আবার এগিয়ে চললাম। এই রাস্তাটা রাঁচি জামশেদপুর জাতীয় সড়ক। আমাদের গন্তব্য দশম প্রপাত। পথে দেখে নিলাম রাঁচির বিখ্যাত সূর্যমন্দির। ১৮টা চাকার রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে সাতটা ঘোড়া। রথের আকারে গড়ে তোলা মন্দিরটা পুরোটাই শ্বেত পাথরের তৈরি। ভিতরের আরাধ্য দেবতা সূর্যদেব। অপূর্ব স্থাপত্যের নিদর্শন এই মন্দির! 

এরপর আরও কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়া। সামনে অপেক্ষারত দশম প্রপাত। অপেক্ষারত বলাটা ঠিক হল কিনা জানি না, কে কার অপেক্ষা করছে! আমরা অপেক্ষায় আছি দু’চোখে ভরে নেব এই প্রকৃতির খেয়ালকে। একটা গ্রাম্য পথ বেয়ে টোটো যেখানে এসে দাঁড়াল,জায়গাটায় চারপাশে বেশ কয়েকটি দোকানপাট। না, দোকান মানে মোটেই শহুরে দোকান বা পরিবেশ নয়। একেবারে খাঁটি গ্রাম্য পরিবেশ। ছোটো ছোটো দোকানপাট খাবারের। মাঝ-দুপুর প্রায়। প্রচণ্ড খিদে পেটে। চারপাশের দোকানগুলোতে টুকটাক খাবার ছাড়া তেমন কিছু নজরেই এল না প্রথমে।

 একটু এগোতেই দেখলাম, কয়েকজন একটা কাপড় দিয়ে ঘেরা স্থানে চেয়ারে বসে কিছু খাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। নয়া, কোনো হোটেল নয়। একজন দেহাতি মহিলা নিজেদের সামান্য খাবার বেশি পরিমানে বানিয়ে রেখেছে। কেউ খেতে চাইলে সেটাই অর্থের বিনিময়ে খাওয়াচ্ছে। দর্শনধারী না সে খাবার,  তবে গুণবিচার ? খিদের মুখে দু’গ্রাস মুখে ঢুকাতেই মনে হল যেন অমৃত। না, এ খিদের মুখে খাওয়ার জন্য মনে হওয়া নয়। বাঁধাকপির ট্যালট্যালে ঝোল, বেশ শক্ত মোটা চালের ভাত আর আলুমাখা। বাঁধাপকপির ঝোল যে এত সুস্বাদু হতে পারে, না-খেলে সত্যিই জানতে পারতাম না। 

এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে দশম জলপ্রপাতকে। উপর থেকে নীচের দিকে লাফিয়ে পড়ছে। প্রবল গর্জন আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছা করছে ঐ জলের কাছে যেতে। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, খাদের মধ্যে সবুজ জল জমে আছে, কিন্তু কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। এখানে আসার আগেই শুনেছিলাম, এখন আর নীচে জল্প্রপাতের সৃষ্ট ঐ জলাশয়ে স্নান করতে দেওয়া হয় না। অতটা উচ্চতা থেকে লাফিয়ে পড়া জলের ধারায় সৃষ্ট গভীর খাদের সবুজ জলাশয়ের যতই আকর্ষণ থাকুক, বিপদ তার থেকেও অনেক বেশি। 

Simple Guidance For You In Ranchi: deuri temple,dasam falls


প্রচুর মানুষ তলিয়ে গিয়েছেন ঐ জলে। আমরা আসার একমাস আগেই সেখানে এক যুবক তলিয়ে যায়, তারপর থেকেই ঐ কাঁটাতারের ব্যবস্থা। একটা স্থানীয় লোক আমাদের পথ দেখাল। আমরা নীচে না নেমে, একটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রপাতের উপরের অংশে পৌঁছালাম। ভয়ঙ্কর সেই রাস্তা। এতক্ষণ আমরা যেখান থেকে জলের ধারাকে লাফিয়ে নীচে নামতে দেখছিলাম, দেখলাম আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের পায়ের তলা দিয়েই বয়ে যাওয়া জলধারাই লাফিয়ে নামছে নীচে। একহাত দূরেই রয়েছে খাদের কিনারা। ভয়ঙ্কর সেই পথ! কীভাবে গেলাম সেখানে এখন ভাবলেই বুকের ভিতরে দ্রুত হৃদ্গতির শব্দ শুনতে পাই। স্বচ্ছ কাচের গুলির মতো চকচকে জল, জমে আছে পাথরের খাঁজে খাঁজে। বাইরে রোদের তীব্রতা তখন যথেষ্ট। জুতোর ভিতরে পা ঘেমে উঠছে। জুতো খুলে সেই স্বচ্ছজলে পা ডুবিয়ে বসতেই শরীর জুড়ে নেমে এল শীতলতা।

 বড় বড় পাথর পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের অলিতে গলিতে এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে জলধারা। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে যেতে হলে ডিঙাতে হবে বহমান জলধারা। কীভাবে যেন হাঁটতে হাঁটতে এমন জায়গায় এসে পৌঁছালাম চারিদিকে বড় বড় পাথর শুধু। যেদিকেই যাচ্ছি সামনে বিশালাকার পাথর। কাছাকাছি কাউকে দেখতেই পেলাম না। ক্ষণিকের জন্য মনে হল,পথ হারিয়ে ফেলেছি। একটা অজানা ভয়ের সাথে রোমাঞ্চ জুড়ে তখন মনের এক অদ্ভুত অবস্থা। দেখলাম একটা পাথরের পিছন দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। ঐধারা ডিঙিয়ে ওপারে যেতে পারলেই রাস্তা পাব। পেরতে গিয়ে পা পিছলে গেল। ঠান্ডা কনকনে জলে ভিজে গেল জুতো। তখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে। ভেজা জুতোয় বেশ কাঁপুনি ধরে গেল। উপর থেকেই দেখতে পেলাম সূর্যটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছে যেন,আর ভীষণ রকম লাল দেখাচ্ছে। আসলে দিগন্ত ছোঁয়ার প্রস্তুতি। আস্তে আস্তে নেমে এলাম সেই গ্রামের পথে। অটো আমাদের নিয়ে ফেরার পথ ধরল। রাস্তায় ধারে অজানা গাছে লাল লাল কচি পাতা ধরেছে। ছুটে চলতে চলতে দেখতে পেলাম,লাল কচি পাতার আড়ালে ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ছে সূর্য। একটা দিন বিদায় নিচ্ছে, নতুন দিনের জন্ম দেবে বলে। কোথা দিয়ে যেন কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। হাতে আর মাত্র একটা দিন। আগামীকালই রাঁচিতে আমাদের শেষ দিন। অনেক জায়গা দেখা বাকি। মনটা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে উঠছে...সারা দিন প্রকৃতির কোলে কাটিয়ে ফিরে এলাম আবার রাঁচির শহুরে ব্যস্ত জনস্রোতের মাঝে।

ক্রমশ...।।