গাছবাড়িটা আর কিছু এলোমেলো গল্পঃ
সন্ধে
নেমেছে অনেক আগেই,তবু গ্রিল ঘেরা বারান্দায় গরম হাওয়ার চলাচল অব্যাহত। টিপটিপ করে বিন্দু
বিন্দু ঘাম জন্মাচ্ছে রোমকূপের গোঁড়ায় গোঁড়ায়। জানি একটু পরেই তারা বড়ো হয়ে গড়িয়ে পড়বে।
চুল গুলো মাথার উপর চুড়ো করে বাঁধতেই ঘারের কাছটা ঠান্ডা অনুভব হল। ছেলের স্কুলের গ্রীষ্মের
ছুটি চলছে।সারাদিন বাড়িতেই কেটে যাচ্ছে নানা ব্যস্ততায়। অন্ধকারে বারান্দায় বসে গ্রিলের
ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশ দেখছি। যখন ভীষণ গরম লাগে,আমি কল্পনায় বরফ দেখার চেষ্টা করি।
পছন্দের মতো একটা বরফের দেশ খুঁজে নিই,আর চোখ বন্ধ করে সেই জায়গায় পৌঁছে যাই। অচেনা
জায়গা হলে ছবিতে দেখা সুন্দর জায়গাগুলোকে সেই জায়গার গায়ে বসিয়ে নিই। অবশ্য এমন কল্পনা
যাপন আমার অবসরের একমাত্র বিনোদন। আকাশ দেখতে দেখতেই দেখলাম, বর্ধমান থেকে সাড়ে সাতটার
ট্রেনটা ধীর গতিতে প্ল্যাটফর্ম ছুঁতে ছুঁতে থেমে গেল। একঝাঁক কোলাহল ধেয়ে এল মুহূর্তের
মধ্যে। খানিক হুড়োহুড়ি ওঠা-নামার মাঝখানেই গঁ-অ-অ করে আওয়াজ করে ট্রেন চলমান হল। আমার
কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটল।
এ
ট্রেনেই সে অফিস থেকে ফেরে। জুন মাসের চার-পাঁচ তারিখ চলছে। অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই
সে বলল, ‘ গাছবাড়ি যাবে?’
--গাছবাড়ি?
সেটা কোথায়?
--সে
বলল, ‘ কাছেই পল্লিশ্রীতে,আরামবাগ’।
আমার
কাছে পল্লিশ্রী মানেই গাছ। এবাড়িতে অজস্র গাছ আছে, যা আরামবাগ পল্লিশ্রী থেকে আনা।
ঐ নার্সারিতেই নাকি গাছবাড়ি আছে।
সেবার
যখন বেতলা জঙ্গলে গিয়েছিলাম, গাছবাড়িতে থাকার খুব ইচ্ছা ছিল। বুকিং করেও ক্যান্সেল
করি। ঠিক থাকার উপযুক্ত ছিল না সেটা। গাছবাড়ির কথায় মনটা নেচে উঠল, কিন্তু গরমের কথা
মনে হতেই ডিহাইড্রেশনের রোগীর মতো ঝিমিয়ে পড়লাম। এমন উত্তপ্ত দিনে লোকে দার্জিলিং,
ডুয়ার্স যায়,গরমে গরম জায়গায় ঘুরতে যাওয়া একপ্রকার পাগলামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু মাঝে
মাঝে নিয়ম ভাঙার একটা আলাদাই আনন্দ আছে। দু-দিন আগেই খবরে বলছিল, নিয়ম মেনে ৮ই জুন
বর্ষা ঢুকছে বঙ্গে। হিসেব মিললে,সোনায় সোহাগা হতে পারে। গাছবাড়িতে বসে,গাছের পাতার
ফাঁক দিয়ে রিমঝিম বৃষ্টিরও দেখা মিলতে পারে।
গাছবাড়ির
এক স্টাফের সাথে আমাদের পূর্বপরিচয় ছিল,বুকিং করতে গিয়ে জানতে পারলাম, ন’তারিখ জামাইষষ্ঠী
উপলক্ষে ভাড়ায় বিশেষ ছাড় চলছে। মধ্যবিত্তের পকেট চিরকালই এই বিশেষ ছাড় শব্দটি শোনার
অপেক্ষায় থাকে,আর সেটা শুনতে পেলে একঝলক চওড়া হাসি ঝলকিয়ে ওঠে।
ন’তারিখ
সকাল,চেনা শহর বর্ধমান যেন একটু একটু করে পিছনে সরে যাচ্ছে,গাড়ির কাচের ভিতর থেকে এশহরকে
দেখিনি কখনও,কেমন যেন অন্যরকম। আরামবাগ রোড ধরে ছুটতে ছুটতে কত কল্পনায় যেন মনের আনাচেকানাচে
ঘুরপাক খাচ্ছে। দামোদরের চরে বালি আর জলের আলপনাকে এমন জায়গায় সূর্যাস্তের একটা কল্পনা
এঁকে নিলাম মনে মনে। কতদিন ভেবেছি,এক বিকেলে ছুঁতে যাব দামোদরকে।কত গল্পই তো শুনেছি
তার। ছোঁয়া হয়নি সে ইচ্ছে। একে একে অনেক চেনা গ্রাম পেরিয়ে চলেছি। পথের দু-ধারে চোখ
রেখে দেখছি জীবন! মুটে জীবন,কেরানী জীবন, চাষী জীবন,চলমান জীবন আবার বসে থাকা আড্ডা
জীবন। বড়ো ছায়া বিলোনো গাছটির নিচে,উবু হয়ে বসা গ্রাম্য বৃদ্ধ আড্ডা। দুই হাঁটুর ফাঁকে
লুঙ্গি গুঁজে, রোদে পোড়া কালো কাঁধে একফালি গামছা ফেলা। কি আলোচনা চলতে পারে? জীবন,সমাজ,নাকি
অভাব? Desmond Morris এর ‘Man Watching’ গ্রন্থটির থেকে জেনেছিলাম অঙ্গভঙ্গি ও অঙ্গবিন্যাস
বিষয়টি,কিন্তু এই মানুষগুলির মুখভঙ্গি বড্ড বেশি নির্লিপ্ত মনে হল,একঝলক দেখার ফাঁকেই।
সরল ভাবলেশহীন জীবন বড্ড বেশি কম্পাউন্ড গেসচারের অংশ যেন!
একটা
গ্রামের বাইরের সীমানা দিয়ে বয়ে চলা রাস্তা ঠিক কতটা আর গল্প শোনাতে পারে গ্রামের?
আমরা তো বেশিরভাগ সময়ই ঐ অঙ্গবিন্যাস আর ভঙ্গি দেখেই বাকি গল্পটা আন্দাজ করে নিই। তবে
অনেক সময় জড় বস্তুও তার গেসচার দিয়ে অনেক গল্প বলে। চলতে চলতেই নজরে এল বিস্তীর্ণ ফাঁকা
প্রান্তরের মাঝে একটা পরিত্যক্ত পাকা বাড়ি। বেশ সুন্দরই তো দেখতে ছিল! একটা ছোট্ট খোলা
বারান্দা। যদিও রোদ খেলছে সে বারান্দায়,তবু বিবর্ণ! কংক্রিট ভেদ করে গাছ জন্মেছে। কার্নিশে
জমেছে শ্যাওলা! বুনো ঘাসের স্বর্গরাজ্য। বন্ধ জানালা যেন তার অঙ্গবিন্যাস দিয়ে ভিতরের
গল্পটা জানাতে চাইছে! একটা পরিপূর্ণ বাড়ি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ ইতিহাসের গল্পে।
ভেবেছিলাম পথের ধারেই কোনও ঘুন্টি থেকে খাবার কিনে
খাব, কিন্তু এপথে কেউ পসরা সাজিয়ে অপেক্ষা করে না পথিকের। খিদের সময় খাদ্য যদি,বিলাসিতার
সোনার হরিণ হয়,তবে সে বড়ো যন্ত্রণার! এযন্ত্রণার অনুভব আমাদের নেই,কিন্তু জানি এই পথ
চলার দু-পাশে অনেক চোখই খিদের সময় সোনার হরিণ খোঁজে! আমার গ্রামবাংলার অপরূপ রূপের
মাঝে এ খিদের গান বড়ো বেদনার মতো বাজে। নিজের নামের সাথে মুশাফির লিখতে ইচ্ছা হয় খুব,
কিন্তু আমি জানি,আমি মুশাফির নই। আমি এক ভ্রমণবিলাসী স্বল্প সময়ের পথিকমাত্র। সফর যতই
ছোট হোক,পথচলার মাঝে দু-দন্ড থামা পথিকের ধর্ম। একটা জিরান-ঘুন্টিতে দাঁড়িয়ে উষ্ণ দুধ-চায়ে
ভিজে ওঠা মাঠির ভাঁড়ের গন্ধ না নিলে, অসীম একটা শূন্যতা ভিড় করে মনে। একটু দূরেই একটা
গনগনে আঁচ ওঠা উনুন। হালকা ধোঁয়ার একটা পরত উড়ছে তখনও। ঘুন্টির মালিক, উনুন আর আমদের
মধ্যের সমস্ত প্রাচীর ভেদ করেছে একটি শব্দ প্রতীক্ষা। ওই উনুনের দিকে তাকিয়েই মনে হল,
সে প্রতীক্ষায় আছে একটি জল ভর্তি কেটলির। ঘুন্টির মালিক খদ্দেরের আর আমরা, সেই তৃপ্তির
এক চুমুকের। কখনও কখনও সময় কী ভীষণ ভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমরা সবাই একে
অপরের পরিপূরক।
-গাড়ি
থেকে নেমে বললাম, ‘চা হবে ভাই?’
--ছেলেটি
জানতে চাইল, ‘কী চা দিদি? লাল চা, না দুধ চা?
--
আমি বললাম, দুটি লাল চা,আর দুটি দুধ চা। আমার ছানাটাও চা খেতে ওস্তাদ। দুধ চা ওর আর
আমার।
হ্যান্ডেরলে
কাপড়ের ব্যান্ডেজ জোড়ানো কেটলি চড়ে বসল গনগনে আগুনের মাথায়। দুধ মেশানো জলে চা-পাতা
পড়তেই সতর্কবার্তা জারি করলাম, ‘ভাই, চিনি কিন্তু কম দেবেন’।
সবাই
বলে, জিরান-ঘুন্টির চা নাকি একগজের হয়। মানে তিনবার ফোটানো। না না, এ চা একেবারে টাটকা।
আমি চা-দোকানকে জিরান-ঘুন্টি বলি। পথিকের জিরান-ঘুন্টি।দু-দন্ড জিরানো তো যায়। আর মিনিট
পঁচিশেক পথ বাকি।
পল্লিশ্রী
মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তাটা বেঁকে গিয়েছে বাঁকুড়ার
দিকে আর সামনের রাস্তাটা সোজা আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড। গাছবাড়ি আমাদের খুব কাছেই...
একটা
বিরাট গেট দু-পাল্লার, ভিতরে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি গার্ড। গেটের গায়ে লেখা “আরামবাগ পল্লিশ্রী”।
ড্রাইভার নামানো কাচদিয়ে মুখ বের করে বলল, ‘গাছবাড়ির বুকিং আছে’।
গেট
খুলে গেল।
একটু
এগিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। দু-পাশে গাছ। মাথা তুলে দাঁড়ানো বড়ো গাছ ছাড়াও ছোটো ছোটো চারাগাছ।
আর বড়ো বড়ো খাঁচার মধ্যে রঙ্গিন পাখির কিচিরমিচির। এখানেই নামতে হবে।বাকি পথ হেঁটে।
কিন্তু, কোন দিকে? সামনে তো কোথাও গাছবাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। ওদিকে চারাগাছ দেখে জিভ
লকলক করছে আমার। স্বাভাবিক আকারের নার্সারির তুলনায় এই নার্সারির আকার বর্ণনা করা মুশকিল।
কোনদিকে যাব ভাবছি যখন,ঠিক তখনই মুশকিল আসানের মতো একটা সাইকেল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল
একটি লোক। মুখজোড়া হাসি। আমাদের ব্যাগ-পত্তর সাইকেলে চাপিয়ে আগে আগে সে চলতে লাগল,আর আমরা পিছে পিছে। একটা বিশালাকার
খাটালে বৃহৎ আকারের খান আটেক গরু নিবিড় মনে খাচ্ছে। ডানপাশে গোবরের স্তুপ থেকে গন্ধ
ছড়াচ্ছে। একঝাঁক মাছি ভনভন করে ঘুরে মরছে। কখনও কারোর কানে,অথবা থ্যাবড়া মুখের উপর
জেগে থাকা নাকের ছিদ্রপথে প্রবেশের অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। গরুর লেজ,চামড়ের মতো
এপাশ-ওপাশ দুলছে। ভাসাভাসা নির্লিপ্ত চোখের উদাস দৃষ্টি কোনদিকে বুঝে ওঠা মুশকিল। কোনও
দিনও বুঝতে পারিনি, জাবর কাটতে কাটতে গরু ঠিক কোন দিকে তাকায়,অথবা কী ভাবে? গরু দেখেই
মনে এল দুধের কথা। আমাদের পথপ্রদর্শককে বললাম-
খাঁটি
দুধের চা পাওয়া যাবে এখানে?
লোকটি
হেসে বললে, ‘ হ্যাঁ, ম্যাডাম।চা তো পাবেনই,চাইলে দুধও খাওয়াতে পারি’।
শুনেই
লোভ হল। এমনিতেই আমি দুধ-চা লোভি মানুষ। অচেনা কারোর বাড়িতে চট করে চা খেতে ভয় লাগে,
কারণ চা-বিলাসি মানুষতো, একটু উনিশ-বিষ হলেই মনে হয়,চা-টাই মাটি হল। মন খারাপ হয়ে যায়।
খাটালের
প্রাচীর কেটে একটা ছোট্ট সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। উপরে রাস্তা। দারকেশ্বর নদের পাড়ের
বাঁধ এটা। দূরের গ্রামের সাথে মূল সড়কের সংযোগ ঘটিয়েছে একটা কালো পিচের রাস্তা। সাইকেল,মোটরসাইকেল
যাওয়া-আসা করছে। পুরো প্রকৃতি জুড়ে একরাশ নিস্তব্ধতা! ঘন ঘাছের জঙ্গলের বুক চিঁড়ে এরাস্তা
চলে গিয়েছে কোনখানে! সরু রাস্তা পেরিয়ে ওই বাঁধের ঢাল বেয়ে নেমে গিয়েছে সিঁড়ি।একটা
তারকাঁটার গেট খুলে লোকটির পিছু পিছু ভিতরে প্রবেশ করলাম।
‘এ কোথায় এলাম!’
বিস্মিত
আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম। এক কোন মায়াবী আশ্রম, নাকি পবিত্র তপোবন! সুউচ্চ বৃক্ষরাজি
সারি সারি মাথা তুলে আকাশমুখী। একটা ঘনছায়া ঝিরঝির করে ঝড়ে পড়ে বনময় ছড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রখর গ্রীষ্মের দাপটকে ম্লান করে শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়েছে যেন। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছায়া
মাখতে মাখতে এগিয়ে চললাম। বড়ো বড়ো গাছের পাদদেশে দলবেঁধে দুলছে ঝোঁপ-ঝাড়। একটা ছোট্ট
ঝোরার মতো নালার উপর বাহারি ছোট্ট বাঁধ পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম গাছ-বাড়ির সামনে। তারকাঁটার
সীমানার গা-ঘেঁঘে পরপর চারটি তালগাছের উপর দাঁড়িয়ে আছে গাছবাড়ি। ফরাক্কায় থাকতে আমাদের
সামনের কোয়ার্টারে একটা খেজুর গাছে ঝুলতে দেখতাম বাবুই পাখির বাসা। নিখুঁত বুনন। গাছবাড়ি
গুলি দেখেই মনে মনে হল পাখিরবাসার মতো বাড়িগুলি যেন মানুষের বাসা। প্রতিটি বাড়ির গায়ে
লাগা একটি করে আমগাছ। ডালপালা দিয়ে বাসাগুলি যেন ঘিরে রেখেছে, চাটাইয়ের দেওয়াল, কাঠের
সিঁড়ি আর বাঁশের সরু বারান্দা। হাঁটলেই মচমচ শব্দ হয়। চারটি বাড়ির একটি রেস্টুরেন্ট।
দুটি করে জোড়া। ভারি সুন্দর নাম বাড়িগুলির। ‘আম্রপালি’, ‘গোলাপখাস’, ‘তোতাপুরি’, আর
রেস্টুরেন্টের নাম ‘ হিমসাগর’।
‘আম্রপালি’
আমাদের আগামী দু’দিনের বাসস্থান। হিমসাগর আর আম্রপালির একটি কমন কাঠের সিঁড়ি।
কিছুটা উঠে ডানদিকে আম্রপালি আর বামদিকে হিমসাগর। ঠিক একই ভাবে যুক্ত পরের বাড়ি
দুটির নাম “ গোলাপখাস” আর “তোতাপুরি”। সবই আমের নাম।
তখনও
রেস্টুরেন্টের ভিতরটা দেখিনি, আমগাছের বনে দাঁড়িয়ে আছি। সাইকেলে যিনি লাগেজ নিয়ে
এলেন, তিনি লাগেজগুলো একটা টেবিলে রেখে সামনেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ বাইরেই অপেক্ষা করতে হবে,বুঝলাম ঘর আমাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
চারিপাশের ছায়ামেদুর বনানী জুনের তীক্ষ্ণ তাপকে শুষে নেওয়ের পরও যেন তাপের হলক
লাগছে। তবু মনজুড়ে প্রসন্নতা। হঠাৎ দেখি তিনটি শাঁসওয়ালা ডাব নিয়ে একটি ছেলে এগিয়ে
এল। এখানে অতিথিদের এভাবেই আপ্যায়ন করা হয়। একটু দূরেই রেস্টুরেন্টের
বাইরে,রান্নাঘরের ঠিক সামনেই পাতা আছে একটা কাঠের টেবিল। চারটে চেয়ার গোল গোল কাঠ
জোড়াদিয়ে তৈরি। বন্য আভিজাত্য রয়েছে একটা। ফুট কয়েকদূরে তারের বেড়া, ওপারে দারোকার
ক্ষীণ স্রোত!
আমরা আম্রপালির অন্দরে ঢুকে চমকে গেলাম। সব
সুযোগসুবিধা যুক্ত সুসজ্জিত রুম। কাচের ঘেরা জানালার ওপাশে দেখতে পেলাম সবুজ গাছের
ডাল জানালা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে। জানালা খুলে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে সে সবুজ। পাতার
ফাঁকে চোখ আটকাল খুব কাছ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণকায় দারকেশ্বর নদ। দূর থেকেই বোঝা
যাচ্ছে জল প্রায় নেই। বুকে জমে আছে ময়লা! স্নান সেরে বাইরে এসে বসলাম ঐ উন্মুক্ত
কাঠের চেয়ারে। একরাশ প্রশান্তি মন জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। এমন নির্জনতায় গা-ভাসাব
বলেই তো এই গরমেও ছুটে আসা। সামনেই রান্নাঘর। একটা টেবিল ঘিরে দু-তিনজন স্টাফ
নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এক’টা প্রায় বেজে গিয়েছে,পেটে ছুঁচোর ডন চলছে। খাওয়ার কথা
জিজ্ঞাসা করতেই স্টাফেদের একজনের মুখটা ছোট্ট হয়ে গেল। বলল—
ম্যাডাম, আর
একটু অপেক্ষা করতে হবে।
বললাম, এখনও
খাবার হয়নি?
লোকটি
কাচুমাচু মুখে জানাল, হয়েছে তবে, রেস্টুরেন্টে যাঁরা খাচ্ছেন,তাঁরা অন্য কোনো
গেস্টকে ঐ মুহুর্তে সেখানে না পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
মানে! এটা
আবার কেমন আচরণ! রেস্টুরেন্টে একটা বিশাল বড় টেবিলে ছ-সাত জন খেতে বসতে পারে।
একটাই টেবিল,তবে বাকি অংশে যে কেউ বসতে পারে। কীভাবে একটা পরিবার সেই কমন স্পেসকে
পার্শোনাল করতে পারে! বিস্মিত হলাম, কিন্তু রাগ দেখালাম না। কারণ, এখানে যাঁরা কাজ
করেন কেউ প্রফেশনাল নয়। সবাই গ্রামের মানুষ। তাঁদের সাহস কোথায় শহুরে বাবুদের
প্রশ্ন করার বা আদেশ অমান্য করার। আমাদের সহযোগিতায় যেন লোকটি বড়ো করে শ্বাস নিল।
বলল—
মালিককে বলা
হয়েছে,এই সমস্যার কথা। আপনারা সত্যিই ভালোমানুষ!
ভালো মানুষ কিনা জানি না, তবে মানুষর অসহায়তা
বোঝা মানুষেরই ধর্ম। কিছুক্ষণ পর সেই পরিবারের দুই মহিলা সদস্য ও এক পুরুষ সদস্য
গটমট করে নেমে এল কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। বাইরে বসার ইচ্ছায় আমরা যেখানে বসে আছি সেই
দিকে একবার তাকিয়ে দেখেও নিল। ভাবলাম হয়তো এবার আঙুল নেড়ে বলবে –‘এই ওঠ ,ওখানে
আমরা বসব’। না আমাদের বলার সাহস বোধহয়
জোটাতে পারেনি, তবে স্টাফেদের একটি ছেলেকে আঙুল নেড়ে তুই সম্বোধনে কাছে ডেকে কিছু
একটা বলল। হায়রে...বাবুয়ানি! মনে মনে একরাশ করুণা ছুঁড়ে দিলাম ঐ পরিবারকে। রবিরার
দুপুরের পর পুরো ফাঁকা জায়গাটা। পুরোটা জুড়েই যেন আমাদের রাজত্ব। একটি স্টাফ
ফুচুদা বললেন, ‘স্যার, আর কোনো অসুবিধা হবে না। যা খাবেন শুধু আগে থেকে বলে
দেবেন,না হলে জোগাড় করা মুশকিল। বললাম, শাঁস আছে এমন ডাব আর পাওয়া যাবে?
উঁনি
জানালেন আনিয়ে রাখবেন। সন্ধের স্ন্যাক্স আর রাতের মেনুও দুপুরেই জেনে নিলেন। বেলার
দিকে গরমের তীব্রতা উপেক্ষা করা দায়। এসিরুমে সারাটা দুপুর কাটিয়ে ঠিক বিকালে নেমে
এলাম নীচে খোলা লনে। পায়ের নীচে ঘাসহীন মাটি। মাথার উপর গাছের ছায়া। সামনেই অবারিত
উন্মুক্ত প্রকৃতি। সন্ধে হওয়ার আগেই ছোটু বলে ছেলেটি নার্সারি দেখে আসার কথা বলতেই
পা বাড়ালাম ঐ দিকে। নার্সারির মালিকের অদ্ভুত সখ। অসংখ্য পাখির খাঁচা। ম্যাকাউ
থেকে অনেক অজানা রঙিন পাখির প্রতিটি খাঁচা দেখার জন্য আলাদা লোক আছে। আমরা যেতেই
একটা বিশেষ জীবাণুনাশক ওষুধ স্প্রে করে আমাদের খাঁচার ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হল। এমন
অভিজ্ঞতা নতুন আর বড় অদ্ভুত। হাতে পাখির খাবার নিতেই একসাথে অনেক পাখি এসে বসল
হাতের উপর। হাত থেকে খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল দানা। এক অদ্ভুত অনুভূতি!
ধীরে ধীরে
সন্ধে নেমে এল। ফিরে এলাম আগের জায়গায়। অদ্ভুত মায়াময় লাগছে জায়গাটাকে। রান্নাঘরের
সামনে একটা ছোট্ট আলোয় চারিদিকে এক আলো-আঁধারি খেলায় গা-ভাসিয়ে এক অনন্ত শূন্যের
দিকে অলস ভাবে চেয়ে থাকা আর একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া সময়কে উপভোগ করার যে একান্ত
অনুভূতি,তা বোধহয় শব্দে সঠিক প্রকাশ সম্ভব নয়! ঝিঝিঁর ডাকে নিস্তব্ধতার অস্তিত্ব
প্রমাণ করছে প্রকৃতি। ঘরোয়া পকোড়ার সাথে,খাঁটি দুধের ঘন চা বিলাসিতার গায়ে যেন
নক্সা চাদর! পরের দিনের জন্য তিন গ্লাস খাঁটি দুধ অর্ডার দিয়ে রাখলাম। রাধুনি
প্রফেশনাল নন,কিন্তু অসাধারণ তাঁর হাতের রান্না! সম্পূর্ণ বাড়ির পরিবেশ যেন। টুকরো
টুকরো হাসি ঠাট্টা, দোলনায় বসে গান শোনা, যেন ব্যস্ত জীবনের মাঝে স্বপ্নের
বাস্তবতা। উপরের দিকে মুখ তুলে চাইতেই দেখলাম, ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি আলো জ্বলিয়ে উড়ে
বেড়াচ্ছে। জোনাকির আলো আসলে সঙ্গীকে সঙ্গমে আকৃষ্ট করার জন্য। একটা ছোট্ট পতঙ্গের
জীবনচক্র প্রকৃতির শোভা হতে পারে,তা জোনাকিকে এমন উন্মুক্ত ভাবে জ্বলতে না দেখলে
কল্পনা করা সম্ভব নয়।
রেস্টুরেন্টটি
কিন্তু ভীষণ সুন্দর! আর রোমান্টিক। ভিতরের মৃদু আলোয় মায়াবী মুহূর্তরা ভিড় করে,আর
কাচের দেওয়ালের ওপারে আধজাগা সভ্যতার টিমটিম করা আলো এক অন্য জগতের অনুভূতি জাগায়।
পরেরদিন এই গ্রাম্য মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ছোট্ট করে আনন্দে মাতলাম! জীবনের সাথে
একটা নতুন বসন্ত জুড়ে যাওয়ার আনন্দ উদ্যাপন। জীবনকে এভাবেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা।
এখানে জীবন আর প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক যেন। দু’হাতে তোলো আর মেখে নাও। চাওয়া আর
না-পাওয়ার অতলে হারাতে হারাতে দুটি দিনের জীবনকে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ আরোও দ্বিগুণ
হল, যখন জানলাম আমাদের মতো ঘুরতে আসা অসংখ্য মানুষের বিলাস যাপনের টাকায় পরিচালিত
হয় একটি অনাথ আশ্রম “ উত্তরায়ণ”।
হ্যাঁ, এটা
একদম একশ শতাংশ সত্যি। এই তিনটি গাছবাড়ির ভাড়া, অতিথিদের খাওয়া থেকে যে উপার্জন
হয়,সেই টাকায় একটি অনাথ আশ্রমের অসংখ্য বাচ্চার প্রতিপালন হয়। আঁকা হয় স্বপ্ন সেই
অনাথ শিশুদের চোখে।
দোলনায়
দুলতে দুলতে পার করতে ইচ্ছা করে রাত, অথাবা শতাব্দীর পর শতাব্দী। কালের নিয়মে ভোর
আসে। শুরু হয় ব্যস্ততা রোজকার জীবনে ফেরার। লাগেজ গুছিয়ে নীচে নামি। বিদায় বলতে
ভালো লাগে না। বেরোনোর আগে বললাম, ‘আবার আসব’ যদিও জানি কিছু পথ থাকে,যে পথে ফেরা
হয় না আর, অথবা ফিরতে নেই, শুধু রেখে যেতে হয় পদচিহ্ন। গাড়ি আবার ছুটতে থাকে শহরের
ব্যস্ততায়।
যোগাযোগঃ
Aambagan, (pallisree, arambag)
Contact no:
9230085084